atipabna.blogspot.com
লেবু চাষ
পুষ্টির চাহিদা পূরণ এবং খাদ্য তালিকায় বৈচিত্র্যতা নিয়ে আসার জন্য আমাদের দেশের নানান ধরণের শাকসবজি ও ফলমূলের চাষ করা হয়। এসব ফলমূলের মধ্যে লেবু অন্যতম। লেবু একটি টক জাতীয় জনপ্রিয় ফল। এর ইংরেজি নাম খবসড়হ ও বৈজ্ঞানিক নাম ঈরঃৎঁং ষরসড়হ. বাংলাদেশের সব এলাকাতেই লেবুর চাষ হয়। একটি পূর্ণাঙ্গ বয়স্ক গাছ বছরে ২০০টি পর্যন্ত ফল দিতে পারে। বাংলাদেশের সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও মৌলভীবাজারে লেবু বেশি জন্মে।
পুষ্টিমান
লেবুতে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ আছে।
ঔষধিগুণ
লেবুর রস মধুর সাথে অথবা লেবুর রস লবণ বা আদার সাথে মিশিয়ে পান করলে ঠান্ডা ও সর্দি কাশি উপশম হয় এবং যে কোন ক্ষত শুকায়।
বাজার সম্ভাবনা
আমাদের দেশে প্রায় সারাবছরই লেবু পাওয়া যায়। লেবু দিয়ে সরবত তৈরি করা হয় এবং লেবু সালাদে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া লেবু দিয়ে আচার তৈরি করা হয়। নানান খাবারে টক স্বাদ আনতে লেবু ব্যবহার করা হয়। লেবু খুবই জনপ্রিয় তাই সব সময় এর চাহিদা থাকে। লেবু চাষ করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি বাড়তি আয় করাও সম্ভব। এছাড়া দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিয়ে থাকে। লেবু বিদেশে রপ্তানি করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
লেবু উৎপাদন কৌশল
জাত
* কিছু উচ্চফলনশীল লেবুর জাত
এছাড়া বাউ কাগজী লেবু-১, বাউ লেবু-২ ও বাউ লেবু-৩ নামে উন্নত জাতের লেবুর চাষ করা হয়।
তথ্যসূত্র : কৃষি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, জুন ২০০৭, গরপৎড়ভরহধহপব ভড়ৎ গধৎমরহধষ ধহফ ঝসধষষ ঋধৎসবৎং (গঋগঝঋ) চৎড়লবপঃ, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সেল-১, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), ঢাকা।
* চাষের উপযোগী পরিবেশ ও মাটি
জলবায়ু
মাটির প্রকৃতি
মার্চ-অক্টোবর মাসে চারা রোপণ করতে হয়।
লেবু হালকা গভীর ও নিষ্কাশন সম্পন্ন দো-আঁশ মাটিতে ভালো হয়। তবে মধ্যম অম্ল মাটিতেও লেবু উৎপাদন করা যায়।
চারা তৈরি
চারা বীজ থেকে উৎপন্ন হয়। তবে কলম থেকে চারা উৎপাদন করেও চাষাবাদ করা সম্ভব।
চারা রোপণ পদ্ধতি
১. গুটি কলম ও কাটিং তৈরি করে বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি (মে) থেকে আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি (অক্টোবর) সময় চারা রোপণ করা হয়।
২. ৫ মিটার ঢ ৫ মিটার দূরত্বে চারা রোপণ করতে হয়।
৩. ৮-১০ মাসের চারা রোপণ করা হয়।
সার প্রয়োগ
কৃষকদের মতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে লেবু চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশি যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশেপাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদির স্তুপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
সেচ ও নিষ্কাশন
১. শুকনা মৌসুমে ২-৩ বার সেচ দিতে হয়।
২. বর্ষার সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমতে না পারে সেজন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
রোগবালাই
১. প্রধান প্রধান শেকড়ের মধ্যে লেবুর পোকা ও ফলমাছি কাঁচা ফল থেকে রস শুষে নেয়।
২. ফলমাছি ফলের ভেতরের অংশ ক্ষতি করে।
৩. মিলিবাগ (পোকা) গাছের বিভিন্ন অংশ থেকে রস শুষে নেয়।
প্রতিকার
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।
চাষের সময় পরিচর্যা
১. একটি গাছ থেকে আরেকটি গাছের দূরত্ব ১৫-২০ ইঞ্চি হতে হবে।
২. শক্ত মাটি গাছের চারদিকে সরিয়ে দিতে হবে।
৩. অতিরিক্ত এবং শুষ্ক ডাল ছাঁটাই করতে হবে।
ফল সংগ্রহ
ফল কিছুটা হলুদ রঙ ধারণ করলে ভাদ্র মাসের শুরু থেকে আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়।
উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ
লেবু প্রায় সারাবছরই উৎপন্ন হয়। বারি লেবু-১ (এলাচি লেবু) জাতের গাছে বছরে প্রায় ১০০-১১০টি লেবু ধরে। বারি লেবু- জাতের গাছে প্রায় ১৮০-১৯০টি লেবু ও বারি-৩ জাতের গাছে বছরে প্রায় ২০০-২২০টি লেবু ধরে।
লেবু উৎপাদন খরচ
* ১বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে ফসল উৎপাদন খরচ
খরচের খাত
পরিমাণ
আনুমানিক মূল্য (টাকা)
বীজ/চারা
১০০টি
১৫০০
জমি তৈরি
মাদা তৈরি
১২০০
সেচ
২-৩ বার
৫০০
শ্রমিক
৬ জন
৯০০
সার
প্রয়োজন অনুসারে জৈব সার
এই সার বাড়িতেই তৈরি করা সম্ভব। তাই এর জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন নেই।
বিকল্প হিসেবে (প্রতি গাছে)
টিএসপি=৯ গ্রাম (১ কেজি=২৩ টাকা)
ইউরিয়া=২৭ গ্রাম (১ কেজি=১৫ টাকা)
এমপি=২০ গ্রাম (১ কেজি=২৮ টাকা)
৩০
কীটনাশক
প্রয়োজন অনুসারে জৈব বা রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার
নিজস্ব/দোকান
জমি ভাড়া
একবছর
৪০০০
মাটির জৈব গুণাগুণ রক্ষা ও উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য জৈব সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ বাড়তে পারে।
তথ্যসূত্র : মাঠকর্ম, চাটমোহর, পাবনা, অক্টোবর ২০০৯।
মূলধন
এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে লেবু চাষের জন্য প্রায় ৫০০০ টাকার প্রয়োজন হবে। মূলধন সংগ্রহের জন্য ঋণের প্রয়োজন হলে নিকট আত্মীয়স্বজন, সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও)-এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এসব সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে।
প্রশিক্ষণ
লেবু চাষ করার আগে অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে লেবু চাষ সম্পর্কে খুঁটিনাটি জেনে নিতে হবে। এছাড়া চাষ সংক্রান্ত কোন তথ্য জানতে হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্ধারিত ফি এর বিনিময়ে কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
লেবু খুবই জনপ্রিয়। তাই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লেবু চাষ ও বাজারজাত করে যে কোন নারী বা পুরুষ নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন।
রবি মৌসুমে ফসল উৎপাদনে সুষম সার ব্যবহারে
কৃষক ভাইদের প্রতি পরামর্শ
ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাটির উর্বরতা শক্তি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। মাটির উর্বরতা শক্তি সংরক্ষণ করে অধিক ফলনের জন্য ডিএপি সারসহ অন্যান্য রাসায়নিক সার সুষম মাত্রায় ব্যবহার করুন;
ডিএপি ও এমওপি সার ব্যবহার করলে দানা পুষ্ট হয়, ফসলের রোগ-বালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, খরা ও শীত সহনশীলতা বাড়ে, ফসলের গুণগতমান ও সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে এবং ফলন বেশি পাওয়া যায়;
ডিএপি একটি বিশেষ গুণগতমান সম্পন্ন সার। ডিএপি সারে ইউরিয়া ও টিএসপি দুটি সারের গুণাগুণ বিদ্যমান;
ডিএপি ব্যবহার করলে টিএসপি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না;
প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ডিএপি সারে ২০ কেজি ইউরিয়া পাওয়া যায়;
টিএসপি এর পরিবর্তে ডিএপি ব্যবহার করলে প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) ইউরিয়া বাবদ প্রায় ১৭০ টাকা সাশ্রয় হয়;
ডিএপি সার খুব তাড়াতাড়ি পানিতে গলে। ফলে দ্রুতবর্ধনশীল এবং স্বল্প মেয়াদের ফসল যেমন- আলু, শাকসবজি, গম, সরিষা ইত্যাদি আবাদে খুবই উপযোগী;
আলু আবাদে পরিমিত হারে পটাশ সার ব্যবহার করা হলে আলুর আকৃতি, মান ও সংরক্ষণগুণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া আলুর রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং বাজার মূল্য ভালো পাওয়া যায়;
রবি মৌসুমে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে ডিএপিসহ অন্যান্য রাসায়নিক সার সুষম মাত্রায় ব্যবহার করে অধিক ফসল উৎপাদন করুন এবং আর্থিকভাবে লাভবান হোন।